ব্যারিস্টার পল্লব আচার্য,আমি আমার গবেষণা ও আইন পেশায় দেখেছি বাংলাদেশের হিন্দু নারীরা বিবাহের পরবর্তীতে অনেক ধরনের সমস্যায় ভুগছেন এবং তা নিরবে নিভৃতে সহ্য করে নেন। তাদের যখন নিরাপত্তার বিষয়টা আসে সর্বপ্রথম যে প্রস্তাব দেয়া হয় তা হলো এককভাবে সেই নারীর দোষ অথবা সেই নারীকে সংসারের সাথে মানিয়ে নিতে বলা হয়।
পৃথিবীর সব থেকে প্রাচীনতম ধর্ম আমাদের সনাতন তথা হিন্দু ধর্মে নারীদেরকে সর্বোচ্চ সম্মান এবং মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। আমরা আমাদের ধর্মীয় গ্রন্থে তা দেখতে পাই যেমন মহাভারতে ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির বলেছেন ভূমি/পৃথিবী থেকেও বেশি সহ্য করার ক্ষমতা মাতা তথা নারীর আছে। নারীরা দেবী দুর্গার মত দশ হাত দিয়ে আমাদের রক্ষা করে যাচ্ছে এবং নারীরা একজন পুরুষের অর্ধাঙ্গীও বটে।
সাধারণত হিন্দু ধর্মে বিবাহ হয় অগ্নিকে সাক্ষী রেখে তন্ত্র মন্ত্র যজ্ঞ দিয়ে, বিশ্বাসের উপর ভরসা করে। কিন্তু বর্তমানে তা পড়ে আছে তার জায়গায়, নারীদের নিরাপত্তা ও সম্পত্তির অধিকারের বিষয় সুস্পষ্ট কিছু বলা নেই। তাই বাংলাদেশ, ভারত সহ বিভিন্ন দেশে হিন্দু বিবাহ নিবন্ধন আইন করা হয়েছে, একমাত্র আইনের মাধ্যমে সম্ভব নারী-পুরুষ উভয় তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে।
বাংলাদেশ হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের জন্য আলাদা করে হিন্দু বিবাহ নিবন্ধন আইন করা হয়েছে ২০১২ সালে। এই আইনের মাধ্যমে হিন্দু নারী এবং পুরুষ উভয় তাদের বৈবাহিক অধিকার ক্ষুন্ন হলে আদালতের শরণাপন্ন হতে পারবেন। সম্প্রতি আমি দেখেছি হিন্দু নারীদের মধ্যে সেপারেশনে যাওয়ার প্রবণতাটা বেড়ে গেছে এবং তা নিয়ে তারা আইনজীবী এবং আদালতের শরণাপন্ন হচ্ছে। আদালতে মামলার মাধ্যমে আইনি প্রক্রিয়ায় তারা সেপারেট বা আলাদা হচ্ছেন। এই আলাদা হওয়ার প্রবণতার ভালো মন্দ দুইটা দিক আছে, ভালো দিক হিসাবে দেখা যায় বর্তমানে নারীরা সচেতন শিক্ষিত এবং তাদের অধিকার সম্পর্কে জ্ঞাত আছেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমি দেখেছি অবিশ্বাস, অনাস্থা, অনান্তরিকতা, অসম বিয়ে ইত্যাদির কারণে বিবাহ বিচ্ছেদ হচ্ছে। আর মন্দ দিক হলো যদি তাদের পরিবারে কোন সন্তান থাকে তার অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ এবং পিতা মাতার আদর স্নেহ ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হওয়া।
আরেকটি বিষয় হলো সম্প্রতি মহামান্য হাইকোর্ট খুলনা জেলার গৌরীদাসী নামক এক বিধবা নারীর কৃষি জমিতে তার অধিকার সম্পর্কে যুগান্তকারী রায় দেন। উক্ত রায়ে সেই বিধবা নারীকে ১৯৩৭ সালের হিন্দু বিধবা সম্পত্তি আইনের বাহিরে গিয়ে বসতভিটা ছাড়াও কৃষি জমিতে অধিকার দেওয়া হয়েছে ন্যায় বিচারের স্বার্থে ( For the interest of Justice) । এই রায়ের মাধ্যমে এটা প্রতিষ্ঠিত হয় যে স্বামী মারা যাওয়ার পরে বিধবা নারীরা শুধু বসতভিটাতেই নয় তার মৃত স্বামীর আয়ের উৎসতে ও অধিকার থাকবে। হিন্দু আইনে দুইটা পদ্ধতিতে সম্পত্তি উত্তরাধিকারীদের মাঝে বন্টন করা হয় একটি হলো দায়ভাগ/ দায়ভাগা আরেকটি হল মিতাক্ষরা। বাংলাদেশে দায়ভাগা পদ্ধতিটি অনুসরণ করা হয়। আইন অনুযায়ী বিধবা নারীরা স্বামীর বসতভিটা ছাড়া অন্য কোন সম্পত্তিতে অধিকার থাকবে না। উক্ত রায়ের অনেকে বিরোধিতা করেছে। এই রায়, আইন করা না হলে তার বাস্তবিক প্রয়োগ সব সময়ই কষ্টসাধ্য বটে।
মধ্যে কথা হলো প্রতিটা আইনের অ্যামেন্ডমেন্ট অথবা রিফর্ম দরকার, সময়ের সাথে সাথে আইনকে পরিবর্তন করতে হয় অথবা নতুন আইন প্রণয়ন করতে হয়। বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম নয়। বর্তমানে প্রতিটি হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের উচিত হিন্দু বিবাহ নিবন্ধন আইন ২০১২ অনুসারে তাদের বিবাহ বাধ্যতামূলক নিবন্ধন করা। এবং নারীদের আর্থিক নিরাপত্তা রক্ষার ক্ষেত্রে হিন্দু বিধবা সম্পত্তি আইন ১৯৩৭ নতুন ভাবে সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে পরিবর্তন করা।
দৈনিক কলম কথা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।